আল-কুরআনের মুজিজা
بِسمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
الحَمْدُ لله نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفُرُهُ وَنُؤْمِنُ به وَنَتَوَكَّلُ عَلَيْهِ - وَنَعُوذُ بالله من شرور أنْفُسَنَا وَمَنْ سَيَّات أعْمَالِنَا مَنْ يهده اللهُ فَلا مُضِلَّ لَهُ وَمَنْ يُضْلِلهُ فَلَا هَادِيَ لَهُ ، وَنَشْهَدُ أَنْ لَا اله الا اللهُ وَحْدَهُ لا شَريكَ لَهُ. وَنَشْهَدُ أَنَّ سَيْدَنَا وَمَولانَا مُحَمَّدًا عَبْدَهُ وَرَسُولُهُ صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلَيْهِ وَعَلى آله وصحبه وَبَارَكَ وَسَلَّمَ . أما بعد فاعوذ بالله من الشيطان الرجيم بسم الله الرَّحْمَنِ الرَّحِيم
وإِن كُنتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّن مثله وَادْعُوا شُهَدانَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَدِقِينَ - فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا ولَنْ تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتي وَقُودُهَا النَّاسُ والحِجَارَةُ أُعدت للكفرين . وَبَشِّرِ الَّذينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّلحَت أَن لَهُمْ جَنَّتِ تجرى من تَحْتِهَا الأَنْهَرُ كُلَّمَا رُزقُوا مِنْهَا مِنْ ثَمَرَةٍ رِزْقًا قَالُوا هذا الذي رُزِقْنَا مِنْ قَبْلُ وَأتُوا به مُتَشَابِهَا وَلَهُمْ فِيهَا أَزْواج مُطهَّرَةٌ وَهُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
بارك الله لنا ولَكُمْ فِي القُرآن العظيم وَنَفَعَنَا وَإِيَّاكُمْ بالايات والذكر الحكيم
আল-কুরআনের মুজিজা
সম্মানিত হাজিরিন,
সূরায়ে বাক্বারার ২৩ নং আয়াত থেকে আলোচনা শুরু:
আজ সূরায়ে বাক্বারার ২৩ নং আয়াত তিলাওয়াত করা হয়েছে। ২১ এবং ২২ নং আয়াতে আল্লাহ তা'আলা একত্ববাদের বিবরণ দিয়েছেন, আর ২৩ নং ২৪ নং আয়াতে রাসূলের যথার্থ যোগ্যতার বিবরণ এসেছে । রাসূলের রাসূল হওয়ার প্রমাণ । হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাসূল হওয়ার জন্য যত প্রমাণ আছে, এর মাঝে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল, পবিত্র কুরআন।
কুরআন কীভাবে রাসূলের সত্যতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ?
এই প্রশ্নের জবাব হল ২৩ নং আয়াত । কুরআনের বহু মু'জিজা কুরআনেই বিদ্যমান। এর মাঝে একটি সাধারণ মু'জিযা হল, কেউ যদি কুরআনের কোনো সূরা বা কোনো আয়াত তিলাওয়াত করে, তাহলে তা প্রতিদিন মজা লাগে। আগের দিন তিলাওয়াতে যে মজা লাগে, পরের দিন তিলাওয়াতেও সে মজাই লাগে ৷
কেউ যদি কুরআনের কোনো সূরার বা কোনো আয়াতের তিলাওয়াত শুনে, আগের দিন শুনলে যে মজা লাগে, পরের দিন শুনলে সেই মজাই লাগে। তারপরের দিন শুনলে সেই মজাই লাগে । এর মজা ঠিক থাকে । এটা কুরআনের একটি বিশেষ মু'জিযা। একমাত্র কুরআন ছাড়া আর যত কিতাব দুনিয়াতে আছে, যত বই-পুস্তক দুনিয়াতে আছে, এর যে কোনো একটি অংশ কেউ যদি একবার পড়ে, মজা লাগলে আরেকবার পড়ে, তারপর আরেকবার পড়ে, এরপর আর পড়ে না ।
কিন্তু কুরআনের এতো বড় জ্বলন্ত মু'জিযা যে, কুরআনের কোনো আয়াত যদি প্রত্যেক দিন পড়ে, প্রথম পড়ায় যে মজা লাগবে পরের দিন পড়লে সেই মজা লাগবে। কুরআনের আয়াত প্রথম দিন শুনলে যেই মজা লাগে, পরের দিন শুনলে সেই মজাই লাগে। এই জন্য কুরআন যার যার সাধ্যমত সুন্দর করে তিলাওয়াত করতে হয় ।
এক হাদীসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
ফরমান :
ليْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَتَغَنَّ بالقرآن .
এই হাদীসের প্রধান ব্যাখ্যা হল, “যে ব্যক্তি কুরআনকে যথেষ্ট মনে করে না” সেই ব্যক্তি আমার উম্মত নয় । আপনারা কি মনে করেন? আমাদের যত সমস্যা আছে, সব সমস্যার সমাধানে কুরআন যথেষ্ট নয় কি?যারা কুরআনকে যথেষ্ট মনে করে না, আল্লাহর রাসূল বলেন, তারা আমার উম্মত নয় । এই হাদীসের অনেক ব্যাখ্যা আছে। এর মাঝে একটি ব্যাখ্যা এটা যে, যাকে আল্লাহ যেই পরিমাণ সুর দিয়েছেন, সেই পরিমাণ সুর দিয়ে যে ব্যক্তি কুরআনকে সুন্দর করে তিলাওয়াত করে না, সে ব্যক্তি আমার উম্মত নয় ।
তা হলে এই হাদীসের দ্বিতীয় ব্যাখ্যা মতে প্রত্যেকের-ই উচিৎ কুরআন তিলাওয়াত করার সময় যাকে আল্লাহ যে পরিমাণ সুন্দর সুর দিয়েছেন, সেই পরিমাণ সন্দর সুর দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে। অবশ্যই এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে, আল্লাহ আমাকে যেই রকম সুর দিয়েছেন, আমি সেই রকমের সুরে পড়ব। আর একজনের সুর আমি নকল করতে যাব কেন?
নিজ সুরে কুরআন তিলাওয়াত করাই উত্তম:
অপরের সুর নকল করে পড়ার নির্দেশ হাদীসে নেই। যাকে আল্লাহ যেই পরিমাণ সুন্দর সুর দিয়েছেন, সেই পরিমাণ সুন্দর সুর দিয়ে পাঠ করবে। এরই মাধ্যমে কুরআনের মু'জিযা প্রকাশ পাবে । একই আয়াত বার বার তিলাওয়াত করলেও মজা কমবে না, একই আয়াতের তিলাওয়াত বার বার শুনলেও মজা কমবে না । যদি এই কুরআন আল্লাহর সত্য কালাম না হতো, তা হলে এমনটি হতো না । আর যখন প্রমাণ হয়ে গেল, কুরআন আল্লাহর সত্য কালাম, তা হলে নাযিল হল কার উপর?
পবিত্র কুরআন নাযিল হল কার উপর?
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর । সুতরাং কুরআনের সত্যতার দ্বারা নবীর সত্যতার প্রমাণ হয় । এইভাবে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন এই কুরআনের মাধ্যমে বহু প্রমানাদি দ্বারা রাসূলের সত্যতা প্রমাণ করেছেন। এর মাঝে একটি প্রমান হল, সূরায়ে বাক্বারার ২৩ নং আয়াত । এখানে আল্লাহ বলেন-
وَإِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّنْ مِثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَائِكُمْ منَ دُون الله ان كُنْتُمْ صَدقِيْنَ .
তোমরা যদি সন্দেহ কর, এই কুরআন সত্যি সত্যিই আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কি না—” তোমাদের যদি সন্দেহ হয়, এই কুরআন আল্লাহর কালাম নয়, এই কুরআন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মনগড়া বানিয়ে বলে । এই কুরআন সত্য কালাম নয়। মুহাম্মদ মনগড়া বানিয়ে আল্লাহর কালামের নামে চালিয়ে দেয়। সে প্রেক্ষিতে আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন তাদের চ্যালেঞ্জ দিলেন এই বলে- وَإِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا “যদি তোমাদের সন্দেহ হয়ে থাকে, তা হলে এক কাজ কর তোমরা। তোমরা যখন লেখা-পড়া করে সাহিত্যিক হয়েছ, পণ্ডিত হয়েছ, তোমরা সবাই সম্মিলিতভাবে এই কুরআনের যত সূরা আছে, এর মাঝে সবচেয়ে ছোট সূরা হচ্ছে ‘সূরাতুল কাউসার' ।
সূরাতুল কাউসারের মতো একটি ছোট সূরা বানিয়ে দেখাও ৷
যে নবী জীবনে কোনো উস্তাদের কাছে লেখা-পড়া করেন নি, তিনি যদি মনগড়াভাবে এই কালাম বানাতে পারেন, তোমরা তো লেখা পড়া করেছ, অতি যুক্তিসংগতভাবে আরও সুন্দর করে বানানোর কথা। এই কথাটা সহজে বুঝার জন্য একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে। যে যুগে হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরব দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এই যুগের বিশেষত মক্কার কুরাইশ বংশের লোকেরা যুগোপযুগী জ্ঞান-বিজ্ঞান ছাড়া অন্যান্য শিক্ষায় খুবই পারদর্শী ছিল; শুধু একটি বিদ্যায় তারা তৎকালীন যুগে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষিত ছিল । বিজ্ঞানে তাদের শিক্ষা ছিল না ।
কিন্তু একটি শিক্ষায় তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষিত ছিল। সেই সাবজেক্ট ছিল, সাহিত্য জ্ঞান । বিশুদ্ধভাবে কথা বলা তারা শিশুকাল থেকেই শিখে নিত। অতি উত্তম বর্ণনা ভঙ্গিতে কথা বলা, আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে কথার পর্যালোচনা তাদের জাতিগত শিক্ষা ছিল। সুতরাং সাহিত্যে তারা সারা দুনিয়ার মাঝে বেশী অগ্রগামী ছিল ।
আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন বলেন “মুহাম্মদ সা. জীবনে কোনো দিন কোনো শিক্ষকের কাছে কথার বর্ণনা ভঙ্গি শিক্ষা গ্রহণ করেন নি” । তিনি যদি এমন সুন্দর কথা বলতে পারেন, তা হলে তোমরা যারা পৃথিবীর সেরা সাহিত্যিক, সারা পৃথিবীর বিখ্যাত কবি তোমাদের এর চেয়ে আরও বেশি সুন্দর মনগড়া কালাম বানানোর কথা।
বেশি সুন্দরের প্রয়োজন নেই, এই রকম সহীহ-শুদ্ধ সাহিত্য সম্পন্ন একটি সূরা, তাও বড় সূরা বানানো দরকার নেই। কুরআনের ১১৪ সূরার সবচেয়ে ছোট্ট সূরার নাম ‘সূরাতুল কাউসার'। সূরাতুল কাউসারের মতো ছোট-খাটো একটি সূরা বানিয়ে দেখাও । তখন বলতে পারবে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ধরনের কথা বলে, সেই ধরনের কথা আমরাও বলি । সুতরাং এগুলো আল্লাহর নাযিল করা কালাম, বিশ্বাস করা যায় না । এটা তার মনগড়া বানানো কথা ।
যদি কুরআন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর নাযিলকৃত নয় বিশ্বাস কর, তা হলে এর নজীর বা দৃষ্টান্ত পেশ কর। ঐ সমাজে নিয়ম ছিল কেউ যদি কারো সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ করত, তাহলে চ্যালেঞ্জনামা কাগজে লিখে কাবা ঘরের দেয়ালে লটকিয়ে দেওয়া হত। এটা ছিল সেই যুগের চ্যালেঞ্জ করার পদ্ধতি। আমাদের বর্তমান গ্রহণযোগ্য চ্যালেঞ্জের পদ্ধতি হল, সাংবাদিক সম্মেলন করে চ্যালেঞ্জের ঘোষণা দেবে, আর না হয় কোনো পত্র-পত্রিকায় চ্যালেঞ্জের ঘোষণা দেবে।
সেই যুগে এরকম সাংবাদিকও ছিল না, আর সেই যুগে আমাদের যুগের মতো সংবাদপত্রও ছিল না। ঐ যুগের চ্যালেঞ্জের নিয়ম অনুযায়ী হযরত রাসূলে কারীম সা.-এর পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জঞ্জনামা লিখে লটকিয়ে দেওয়া হল কা'বা ঘরের দেয়ালে । বলা হল, কুরআনের সবচেয়ে ছোট্ট সূরা, সূরায়ে কাউসারের মতো একটি ছোট্ট সূরা বানিয়ে দাও। চ্যালেঞ্জে তাদেরকে আরো কিছু সুবিধে দেওয়া হল, তোমরা যদি দু'চারজনে মিলে বানাতে না পার, তা হলে এই দুনিয়াতে সাহিত্য জগতে যত পণ্ডিত আছে, তাদের সবাইকে তোমাদের সঙ্গী বানিয়ে তোমাদের সহযোগী বানিয়ে সবাই সম্মেলিতভাবে সূরায়ে কাউসারের মতো একটি ছোট্ট সূরা বানিয়ে তোমরা এই চ্যালেঞ্জের জবাব দাও।
সেই যুগে আরো একটি নিয়ম ছিল, কেউ যদি কারো বিরুদ্ধে কাবা ঘরের দেয়ালে চ্যালেঞ্জনামা লটকিয়ে চ্যালেঞ্জ করত, তা হলে যার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করা হল, সেই লোকটা যতদিন পর্যন্ত চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে না পারত, ততদিন পর্যন্ত সমাজে মুখ দেখাতে পারত না। চ্যালেঞ্জের জবাব না দিতে পারলে সাব্যস্ত হত সে হেরে গেল । কে হারল? কে জিতল, সে কথা যদি প্রমাণ করতে হয়, তাহলে সেই চ্যালেঞ্জের জবাব কাবা ঘরের দেয়ালে লটকাতে হয়। এই ছিল তখনকার সময়ের অবস্থা।সেই চ্যালেঞ্জনামা যখন কা'বা ঘরের দেয়ালে লটকিয়ে দেওয়া হল, তখন তো তারা জবাব না দিতে পারলে সমাজে ওরা হেরে যাবে প্রমাণিত হবে ।
তাই তারা অবস্থার প্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে সমস্ত পণ্ডিতেরা সমেবেত
হল । কা'বা ঘরের
চ্যালেঞ্জ এর জবাবে মনগড়া সূরা বানিয়ে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল। তারা কা'বা ঘরের দেয়ালে
লটকানো সূরায়ে কাউসার যখন দেখল,
তখন তারা বিপাকে পড়ল। এটাকে গদ্য বলারও অবকাশ নেই, পদ্য বলারও অবকাশ
নেই। কারণ, গদ্য যদি
হয়ে থাকে, তখন প্রত্যেকটা
আয়াতে ছন্দের মিল থাকার কথা নয়। কিন্তু সূরায়ে কাউসারের প্রত্যেকটা আয়াতের শেষে
ছন্দ মিল আছে।
إِنَّا
أَعْطَيْنَكَ الْكَوْثَرْ - فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ - أَنَّ شَانِئَكَ هُوَ
الْأَبْتَر
ছন্দ মিল আছে কি?
প্রত্যেকটা আয়াতের শেষের অক্ষর ر , (রা) ওয়াকফের অবস্থায় প্রত্যেকটা আয়াতের শেষে : ر ساکن, হয় । কাজেই এটাকে গদ্য গণ্য করা যায় না ।
কিন্তু আরবি সাহিত্যের পদ্ধতি মতে কোনো পদ্য বানাতে গেলে প্রতি
দু'টি লাইনে
একটি পঙক্তি হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত দু'লাইন মিলিয়ে
পঙক্তি না বানাবে ততক্ষণ পর্যন্ত পদ্য গণ্য হয় না ।
এখানে সূরায়ে কাউসারের প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াত মিলে যদি একটি পংক্তি ধরা হয়, তা হলে তৃতীয় আয়াতের সাথে চতুর্থ কোনো আয়াত নেই, তাই পংক্তি হল না ।
সুতরাং এটা পদ্য হতে পারে না। তারা এমন বেকায়দায় পড়ল যে, এই সূরাকে পদ্য বলবে, না গদ্য বলবে, কোনটাই বলতে সুবিধা করতে পারলো না। সাহিত্যের পরিভাষায় কেউ যদি তার মনগড়া বানায় বা রচনা করে,
তাহলে সেটা হয়ত পদ্য হবে না, হয় গদ্য হবে?
এখন দেখা যায়,
সূরায়ে কাউসারকে না পদ্য গণ্য করার উপায় আছে, না গদ্য গণ্য করার উপায় আছে।
এমতাবস্থায়ও জবাব না দিলে যেহেতু তারা হারবে, এই জন্য সমস্ত পণ্ডিতের দল মাথা ঘামাতে লাগল, কিভাবে আরেকটা সূরা বানানো যায় । শত চেষ্টা করেও তারা একটি সূরা বানাতে পারল না । একটি আয়াত বানাল । আরেকটা আয়াত বানিয়ে সূরায়ে কাউসারের তৃতীয় আয়াতের সাথে দ্বিতীয় লাইন মিলিয়ে একটি পংক্তি তৈরি করল ।
সূরায়ে কাউসারের প্রথম দু'আয়াতকে একটি পংক্তি সাব্যস্ত করে তৃতীয় আয়াতের সাথে চতুর্থ
একটি আয়াত বানিয়ে এই আল্লাহর দেয়া তৃতীয় আয়াত আর তাদের মনগড়া বানানো চতুর্থ আয়াত
মিলিয়ে একটি পংক্তি বানিয়ে এটাকে পদ্য আকারে কাবা ঘরের দেয়ালে লটকিয়ে বাড়ীতে চলে
গেল ।
তারা যে মনগড়া আয়াতটি বানাল, সেই আয়াতটি হচ্ছে—
ليس هذا
كلام البشر
এই সূরা কোনো মানুষের বানানো নয় ।
এটা তাদের বানানো আয়াতের তরজমা।
কথা বুঝে থাকলে বলুন তো তারা জিতল কি? হারল ।
তারাই আয়াত বানাল, আর এই অর্থ হল 'এটা কোনো মানুষের বানানো নয়'। এমন চরমভাবে তারা হারল । আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন যখন চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, তখন বলে দিয়েছিলেন-
فان لم
تَفْعَلُوا وَلَنْ تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ
والحجَارَةُ أُعِدَّتْ لِلْكَفِرِينَ
.
“যদি এই কালামের মতো কালাম বানাতে না পার আর পারবে তো না-ই। ‘যদি না পারো' বলে সাথে সাথে ‘পারবে তো না-ই' - এ কথা বলে দিয়েছেন।”
فَاتَّقُوا
النَّارَ الَّتي وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ
“তাহলে সেই
জাহান্নামের আগুনকে ভয় কর, যেই জাহান্নামের আগুনের জ্বালানী হবে মানুষ
আর পাথর।”
اُعِدَّتْ لَلْکٰفِرِیْنَ
"সেই জাহান্নামের আগুন তৈরি করা হয়েছে যারা পবিত্র কুরআন বিশ্বাস করে না তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য । যারা আল্লাহর বিধানে বিশ্বাসী নয় তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য । এই কথা আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন চ্যালেঞ্জ এর সাথে সাথেই উল্লেখ করে দিয়েছিলেন।
এতোদসত্ত্বেও তারা সমস্ত পণ্ডিতের দল চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে লিপ্ত হল । যখন শত চেষ্টা করে সূরাতুল কাউসারের মতো একটি সূরা বানাতে পারল না, একটি আয়াত যা বানাল, আয়াতের অর্থ দাড়ায় এটা মানুষের মনগড়া কোনো কালাম নয় । এই জন্য আল্লাহপাক তাদের এই শোচনীয় পরাজয়ের দিকে ইঙ্গিত করে সূরায়ে বাক্বারার প্রথমে বলেছিলেন, الم ; এই الم হল কুরআনের মু'জিযার শ্রেষ্ঠ ইঙ্গিত। الم হল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-এর যথাযথ সত্যতার প্রমাণ ।
কিভাবে الم কুরআনের সত্যতার প্রমাণ হয়, কিভাবে الم মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সত্যতার প্রমাণ হয়, তার বিবরণ তাফসীরে বায়যাবী শরীফে লিখা আছে।
আরবি বর্ণমালা উচ্চারণগত দিক থেকে তিন প্রকার:
আরবি বর্ণমালায় যে ২৯টি অক্ষর আছে, এই অক্ষরগুলো উচ্চারণগত দিক দিয়ে তিন প্রকার। আরবি বর্ণমালার কিছু অক্ষর গলার ভেতর থেকে উচ্চারণ হয়, এগুলোকে حروف حلقوم, বলা হয়। আরেক ধরনের অক্ষর মুখের ভেতর থেকে উচ্চারণ হয়, এগুলোকে حروف جوفی, বলা হয় । আরেক প্রকারের অক্ষর ঠোঁটের থেকে উচ্চারণ হয়, এগুলোকে حروف شفوی, বলা হয় ।
حروف حلقی ، حروف جوفی ، حروف شفوی গলা থেকে উচ্চারিত
অক্ষর, মুখ থেকে
উচ্চারিত অক্ষর, ও ঠোঁট
থেকে উচ্চারিত অক্ষর এই তিন প্রকারের আরবী বর্ণমালা ছাড়া চতুর্থ প্রকারের আর কোনো অক্ষর
নেই ।
তাহলে আরবি বর্ণমালা উচ্চারণগত দিক থেকে কত প্রকার? তিন প্রকার ।
এর মাঝে গলার ভেতর থেকে উচ্চারিত অক্ষরগুলো থেকে আল্লাহ নিয়েছেন
الف আলিফের
মাঝে কোনো হরকাত থাকে না। আলিফের মাঝে যখন জের, জবর,
পেশ দেওয়া হয়, তখন আর
আলিফ থাকে না; হামযাহ্
হয়ে যায়। যারা সহীহভাবে তিলাওয়াত জানেন তারা নিশ্চয়ই এর খবর রাখেন ।
সোজা টান দিয়ে 'আলিফ' লিখা হয়। যতক্ষণ
পর্যন্ত তার মাঝে জবর না লাগে,
যতক্ষণ পর্যন্ত তার মাঝে জের না লাগে,
যতক্ষণ পর্যন্ত তার মাঝে পেশ না লাগে,
ততক্ষণ পর্যন্ত এটা ‘আলিফ’ থাকে ।
আর যদি এই তিনটির যে কোনো একটি লাগে, তখন এটা আর আলিফ
থাকে না। সেটার নাম হয় ‘হামযাহ’। কাজেই আলিফ চিনব আমরা কোন সময়? যখন তার ডানের অক্ষরে
জবর থাকে তখন আলিফ আলাদাভাবে চিনা যায় ।
যেমন- با বা আলিফ যবর বা। ب . ا = با বা যবর বা, বা আলিফ যবর বা ب - ا = با বা যবর বা বললে বা লম্বা হয় না, با = বা আলিফ যবর বা বললে লম্বা হয়। با বলে লম্বা করলে পরেই আ-বলে একটি উচ্চারণ হয়, এটা সরাসরি একেবারে গলা থেকে উচ্চারিত হয়। এই কারণে আলিফকে حروف حلقی, গণ্য করা হয়। গলা থেকে উচ্চারিত অক্ষরগুলো থেকে আল্লাহ নিয়েছেন আলিফ মুখের ভেতর থেকে উচ্চারিত অক্ষরগুলো থেকে আল্লাহ নিয়েছেন লাম । যেমন- قل = ক্বাফ লাম পেশ কুল, লাম সাকিন অবস্থায় জিব্বার আগা আর উপরের তালু থেকে উচ্চারিত হয় ।
আর ঠোঁটের থেকে উচ্চারিত অক্ষর থেকে আল্লাহ নিয়েছেন মীম । الف لام میم এই তিনটি অক্ষর নিয়ে আল্লাহ ইঙ্গিত করেছেন, এই তিন প্রকার অক্ষর দিয়ে তোমরা লেখা-পড়া করে পণ্ডিতী কর। এই তিন প্রকার অক্ষর পড়ে তোমরা সাহিত্যিক হয়েছ, কবি হয়েছে। অথচ আমার নবী কোনো উস্তাদের কাছে আলিফও শিখেন নি, লামও শিখেন নি, মীমও শিখেন নি । আমার নবী কোনো দিন দুনিয়ার কোনো উস্তাদের কাছে এ, حروف حلقی ، حروف جوفی ، حروف شفوی ও শিখেন নি ।
তাহলে যে নবী দুনিয়ার কোনো উস্তাদের কাছে এই তিন প্রকারের অক্ষর শিখেননি, তিনি যদি এত সুন্দর কালাম মনগড়া বানাতে পারেন, তা হলে তোমরা যারা এই তিন প্রকারের অক্ষর দ্বারা লেখা-পড়া করতে করতে কবি হয়েছো, সাহিত্যিক হয়েছে, পণ্ডিত হয়েছো, তোমরা পারবে না কেন বানাতে?তোমাদের বানাতে না পারা কি একথার জ্বলন্ত প্রমাণ নয় যে, এই কুরআন মুহাম্মাদের মনগড়া বানানো কথা নয়; এটা আল্লাহর নাযিল করা কালাম ।
الم - এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে এগুলো আল্লাহর নাযিল করা কালাম । আর যখন একথা প্রমাণ হল যে, এই কালাম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বানানো নয়; আল্লাহর নাযিল করা কালাম, তাহলে এ কালাম মিথ্যা না সত্য? সত্য । এ কালামের কথাগুলো সত্য না মিথ্যা? অবশ্যই সত্য ।
এবার এই কালামের কথাগুলোর মাঝে একটি কথা বলে দিচ্ছি। এই কালামের
২৬ পারার সূরাতুল ফাতাহর শেষের রুকুতে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন ফরমান-
مُحَمَّدُ رَّسُوْلُ اللّٰہ
‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এই কালামে আছে কি? অবশ্যই আছে। তাহলে যখন প্রমাণ হল, এই কালাম মনগড়া বানানো কথা নয়, আল্লাহর নাযিল করা কালাম । সাথে সাথে প্রমাণ হল, এ কালাম সত্য । যখন প্রমাণ হল, এই কালাম সত্য, তাহলে এই কালামের ভেতর যত কথা আছে, সব কথা সত্য ।
এই কালামের ভিতরে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' একটি কথা আছে কি? কাজেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল । অতএব কালামের সত্যতার মাধ্যমে এ কথার প্রমাণ হয়ে গেল যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্যি সত্যিই আল্লাহর রাসূল । হুদায়বিয়ার সন্ধির সময়ে যখন উভয় পক্ষের সম্মতিতে সন্ধি সম্পন্ন হয়ে গেল । তখন শুধু লেখা আর দস্তখতের বাকী।এমতাবস্থায় উভয় পক্ষ সন্ধি লেখার জন্য কাগজ-কলম হযরত আলী রাযি.-এর হাতে দিলেন। হযরত আলী রাযি. শিরোনাম লিখলেন-
هَذا مَا
صَالحَ بَيْنَ أَهْلِ مَكَّةَ وَبَيْنَ مُحَمَّدٍ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
এ চুক্তি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর কুরাইশ বংশের নেতাদের মাঝে সম্পাদিত চুক্তিনামা। তারা বলল, কাগজে যদি লিখ, তাহলে আমরা দস্তখত করব না । ব্যাপার কী ?
ব্যাপার হচ্ছে, মুহাম্মদকে আমরা রাসূল মানি না, এই জন্যই তোমাদের সাথে আমাদের দ্বন্দ্ব । যদি মুহাম্মাদকে রাসূল মেনে নেই, তাহলে তো তোমরা আর আমরা এক হয়ে গেলাম । তোমরা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. মান; আর আমরা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ মানি না- এই হল দ্বন্দ্বের মূল । এমতাবস্থায় মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ যে কাগজে লিখা হল, এটার মাঝে দস্তখত করা মানেই হল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ মেনে নিলাম ।
( অসমাপ্ত চলবে...)